নিজেকে চিনেতে শিখুন ! আমার আমিকে জাগিয়ে তুলুন। দেখবেন আপনি পারবেন । ( একটি সত্যিকারের লাইফ ট্রাজিডি )




মেয়েটার নাম রুথ। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাওই থেকে নরওয়েতে আমার মতোই বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতি পড়তে এসেছে। ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের মধ্যে সব থেকে চুপচাপ। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতে দেখি না। ওর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলেও ফিরতি হাসি দিতে দেখিনি কখনো। ওর কোনো বন্ধুও নেই। ক্লাসের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও ওর সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত আমার বন্ধুত্ব হয়নি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে, ইকোনমেট্রিকস ক্লাসে আমাদের গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। রুথ আমার কাছে এসে জানতে চায়, ও আমার সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট করলে আমার কোনো আপত্তি আছে কি না। আমি কিছুটা অবাক হলেও রাজি হয়ে যাই। কিন্তু ও এত চুপচাপ আর আমি হলাম ওর বিপরীত। সারা দিন বকবক না করলে আমি অসুস্থ বোধ করি। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হতে মাস খানেক সময় লাগবে। এতটা সময় কথা না বলে থাকব কী করে, এটাই আমার চিন্তা। অনেক কিছু ওকে জিজ্ঞেস করলেও ওর কাছে তেমন উত্তর পেতাম না। কদাচিৎ হ্যাঁ, হু বলেই জবাব দিত। আমি সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে কথা বলে যেতাম আর ও চুপচাপ শুনে যেত।
এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন আমার রুমে বসে আমরা অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলাম। রুথ হঠাৎ চিত্কার করে বলে উঠল, ‘দেখো স্নো ফল হচ্ছে।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি তাই তো, কী অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য! ওর মতো আমারও জীবনের প্রথম স্নো ফল দর্শন। আমি তখন প্রকৃতির এই সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে উপভোগ করছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম রুথ কাঁদছে। ও অঝোরে কাঁদছে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না স্নো ফলের সঙ্গে কান্নার সম্পর্ক কী? ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে বিব্রত না করে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। আর জিজ্ঞেস করলেও যে উত্তর পেতাম না, সে তো জানা কথাই। অনেকক্ষণ পর রুথ ধাতস্থ হয়ে নিজেই কথা শুরু করল। আমি চুপচাপ শুনে যেতে লাগলাম রুথের সত্যগাথা।
মালাওইতে পশ্চাৎ​পদ এক গ্রামে রুথের জন্ম। ওর মা-বাবা কৃষিকাজ করেন। ওর ছোট পাঁচ ভাইবোন আছে। ছেলেবেলাটা কেটেছে অসম্ভব দ​ারিদ্র্যের মাঝে। কিন্তু অভাবের মাঝেও ওরা ছিল অনেক সুখী একটা পরিবার। ওরা খুব হাসিখুশি থাকত সব সময়।
রুথ ছিল অসম্ভব চঞ্চল আর দুষ্টু। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রায়ই ওর নামে বাসায় নালিশ আসত। মায়ের বেদম পিটুনি খেয়েও ও নাকি হিহি করে হাসত। পড়াশুনাতে ওর তেমন মন নেই। তার ওপর বাসা থেকে অনেক দূরের পথ হেঁটে ওকে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে সারা দিন হইচই করে দিন কাটত। কোনো মতে টেনেটুনে নাকি ও পরীক্ষায় পাস করত।
তখন ওর ১২/১৩ বছর বয়স হবে। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন বখাটে একদল নরপশুর হাতে সে ধর্ষণের শিকার হয়। দমবন্ধ করা কষ্টে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর অনেক কষ্টে বাসায় ফেরে। সেই রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে ওর জ্বর আসে। সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল। ভয়ংকর ঘটনাটা ও জ্বরের ঘোরে ওর মাকে বলেছিল কি না, ও মনে করতে পারছিল না।
সুস্থ হওয়ার পর রুথ আর স্কুলে যায়নি। বাইরে খেলতে যাওয়া বা বন্ধুবান্ধব কারও সঙ্গে ওর কথা বলতে আর ভালো লাগত না। বাসায় সারা দিন চুপচাপ থাকত।
এরও কিছুদিন পরের কথা। রুথের শারীরিক পরিবর্তন ও নিজে টের না পেলেও অভিজ্ঞ মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। ওর মা বেশ দূরের এক ডাক্তারের কাছে রুথকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মনে ক্ষীণ আশা। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া রুথের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না।
পরিবারের এহেন বিপদে ওর মা নাকি একটুও ভেঙে পড়েননি। রুথকে শক্ত হাতে আগলে রেখে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছেন। ওর বুদ্ধিমতী মা ছোট ভাইবোনদের বাবার কাছে রেখে রুথকে অনেক দূরে তার বোনের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
রুথের খালা একটা এনজিওতে ভালো চাকরি করতেন। অবিবাহিতা, একা থাকতেন। সেখানে আলো বাতাসহীন একটা ঘরে রুথ অনেকটা বন্দীর মতোই ছিল। ভাগ্যক্রমে ওই বাসায় ছিল বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা। একাকী সময়গুলো রুথ বই পড়ে কাটিয়েছিল। তার মধ্যে স্নো হোয়াইট ছিল ওর সব থেকে প্রিয়। অসংখ্যবার সে রূপকথার সেই বইটি পড়েছিল।
রুথের মা রুথের সঙ্গেই বোনের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ওর বাবা ছোট ভাইবোনদের আনা-নেওয়া করতেন। এভাবেই দিন কেটে যায়। বদ্ধ সেই ঘরেই একদিন রুথ ওর মেয়ের জন্ম দেয়। ফুটফুটে তুলতুলে কৃষ্ণ কালো মেয়ে। ও ওর মেয়ের নাম রাখে ‘স্নো হোয়াইট’।
রুথের মা রুথকে আর বাসায় নিয়ে যাননি। খালার বাসায় রেখে রুথের সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাসায় ফিরে যান। ওর বাবা ছাড়া গ্রামের সবাই জেনে যায় যে, রুথের মায়ের আরও একটি মেয়ে হয়েছে। ভাইবোনেরা জানল যে ওদের ছোট একটা বোন হয়েছে। আর প্রতিবেশীরা জানল যে রুথ শহরে থেকেই পড়াশুনা করবে। মাঝে মাঝে বাসায় আসবে।
রুথ খালার বাসায় থেকে আবার স্কুলে ভর্তি হয়। একদা হাসিখুশি রুথ আরও চুপচাপ। ও দিন-রাত শুধু বই নিয়েই থাকত। একদা অমনোযোগী রুথ ক্লাসের মধ্যে সব থেকে ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। রুথ স্নো হোয়াইটকে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠত। পরীক্ষা শেষে করেই সে ছুটে গেল গ্রামের বাসায়। ছোট্ট স্নো তখন ভাঙা ভাঙা স্বরে রুথের মাকে মা ডাকতে শিখেছে। রুথ তার কাছে অচেনা।
রুথ খালার বাসায় ফিরে আসে। পড়াশুনার ফাঁকেই মাঝে মাঝে স্নোকে বাসায় গিয়ে দেখে আসত। এভাবেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। রুথ কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশুনার ধাপ শেষ করে। ভালো রেজাল্টের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে রুথ নিয়োগ পায়। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে আজ সে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে এসেছে।
রুথের কাছে জানতে পারি যে, স্নো এখন অনেক বড় হয়েছে। রুথকে তার বড় বোন বলেই সে জানে। ম্লান হেসে রুথ জানায়, স্নো কোনোদিন জানবে না কে তার আসল মা।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনের মতো রুথ রুমে ফিরে গেল। আর আমি ঝিম মেরে ভাবতে লাগলাম। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও রুথ নিজেকে গড়ে তুলেছে, পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছে, ওর মেয়েটাকে ও নিজের মেয়ে হিসেবে না পেলেও, মেয়েটা তো ওর পরিবার পেয়েছে!
রুথ এবং ওর মা প্রমাণ করছে যে ধর্ষণের শিকার হলেই মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায় না। নিষ্পাপ রুথ তার জীবনকে অন্ধকারে মিশে যেতে দেয়নি। ও হেরে যায়নি। ও ওর দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেছে। ভাইবোনেরা ভালো স্কুল-কলেজে পড়ছে। ওর স্নো হোয়াইট বড় হয়ে উঠছে।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রুথ দাঁড়িয়ে আছে খোলা মাঠে। হয়তো সে তার আদরের মেয়ে স্নো হোয়াইটকে অনুভব করছে সারা গায়ে শুভ্র স্নোতে আবৃত করে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি লেখার আগে আমি রুথের কাছে অনুমতি চেয়ে নিয়েছি)
লিখেছেনঃ জিনিয়া জাহিদ, এডিলেড (অস্ট্রেলিয়া) থেকে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত।
নিজেকে চিনেতে শিখুন ! আমার আমিকে জাগিয়ে তুলুন। দেখবেন আপনি পারবেন । ( একটি সত্যিকারের লাইফ ট্রাজিডি ) নিজেকে চিনেতে শিখুন ! আমার আমিকে জাগিয়ে তুলুন। দেখবেন আপনি পারবেন । ( একটি সত্যিকারের লাইফ ট্রাজিডি ) Reviewed by Unknown on 7:00 PM Rating: 5

No comments:

Monday, January 26, 2015

নিজেকে চিনেতে শিখুন ! আমার আমিকে জাগিয়ে তুলুন। দেখবেন আপনি পারবেন । ( একটি সত্যিকারের লাইফ ট্রাজিডি )




মেয়েটার নাম রুথ। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাওই থেকে নরওয়েতে আমার মতোই বৃত্তি নিয়ে অর্থনীতি পড়তে এসেছে। ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের মধ্যে সব থেকে চুপচাপ। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতে দেখি না। ওর দিকে তাকিয়ে হাসি দিলেও ফিরতি হাসি দিতে দেখিনি কখনো। ওর কোনো বন্ধুও নেই। ক্লাসের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেও ওর সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত আমার বন্ধুত্ব হয়নি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে, ইকোনমেট্রিকস ক্লাসে আমাদের গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। রুথ আমার কাছে এসে জানতে চায়, ও আমার সঙ্গে অ্যাসাইনমেন্ট করলে আমার কোনো আপত্তি আছে কি না। আমি কিছুটা অবাক হলেও রাজি হয়ে যাই। কিন্তু ও এত চুপচাপ আর আমি হলাম ওর বিপরীত। সারা দিন বকবক না করলে আমি অসুস্থ বোধ করি। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হতে মাস খানেক সময় লাগবে। এতটা সময় কথা না বলে থাকব কী করে, এটাই আমার চিন্তা। অনেক কিছু ওকে জিজ্ঞেস করলেও ওর কাছে তেমন উত্তর পেতাম না। কদাচিৎ হ্যাঁ, হু বলেই জবাব দিত। আমি সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে কথা বলে যেতাম আর ও চুপচাপ শুনে যেত।
এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন আমার রুমে বসে আমরা অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলাম। রুথ হঠাৎ চিত্কার করে বলে উঠল, ‘দেখো স্নো ফল হচ্ছে।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি তাই তো, কী অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য! ওর মতো আমারও জীবনের প্রথম স্নো ফল দর্শন। আমি তখন প্রকৃতির এই সৌন্দর্য মুগ্ধ চোখে উপভোগ করছি, হঠাৎ খেয়াল করলাম রুথ কাঁদছে। ও অঝোরে কাঁদছে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না স্নো ফলের সঙ্গে কান্নার সম্পর্ক কী? ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওকে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করে বিব্রত না করে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। আর জিজ্ঞেস করলেও যে উত্তর পেতাম না, সে তো জানা কথাই। অনেকক্ষণ পর রুথ ধাতস্থ হয়ে নিজেই কথা শুরু করল। আমি চুপচাপ শুনে যেতে লাগলাম রুথের সত্যগাথা।
মালাওইতে পশ্চাৎ​পদ এক গ্রামে রুথের জন্ম। ওর মা-বাবা কৃষিকাজ করেন। ওর ছোট পাঁচ ভাইবোন আছে। ছেলেবেলাটা কেটেছে অসম্ভব দ​ারিদ্র্যের মাঝে। কিন্তু অভাবের মাঝেও ওরা ছিল অনেক সুখী একটা পরিবার। ওরা খুব হাসিখুশি থাকত সব সময়।
রুথ ছিল অসম্ভব চঞ্চল আর দুষ্টু। পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রায়ই ওর নামে বাসায় নালিশ আসত। মায়ের বেদম পিটুনি খেয়েও ও নাকি হিহি করে হাসত। পড়াশুনাতে ওর তেমন মন নেই। তার ওপর বাসা থেকে অনেক দূরের পথ হেঁটে ওকে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে সারা দিন হইচই করে দিন কাটত। কোনো মতে টেনেটুনে নাকি ও পরীক্ষায় পাস করত।
তখন ওর ১২/১৩ বছর বয়স হবে। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন বখাটে একদল নরপশুর হাতে সে ধর্ষণের শিকার হয়। দমবন্ধ করা কষ্টে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর অনেক কষ্টে বাসায় ফেরে। সেই রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে ওর জ্বর আসে। সুস্থ হতে অনেক সময় লেগেছিল। ভয়ংকর ঘটনাটা ও জ্বরের ঘোরে ওর মাকে বলেছিল কি না, ও মনে করতে পারছিল না।
সুস্থ হওয়ার পর রুথ আর স্কুলে যায়নি। বাইরে খেলতে যাওয়া বা বন্ধুবান্ধব কারও সঙ্গে ওর কথা বলতে আর ভালো লাগত না। বাসায় সারা দিন চুপচাপ থাকত।
এরও কিছুদিন পরের কথা। রুথের শারীরিক পরিবর্তন ও নিজে টের না পেলেও অভিজ্ঞ মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। ওর মা বেশ দূরের এক ডাক্তারের কাছে রুথকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মনে ক্ষীণ আশা। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া রুথের সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না।
পরিবারের এহেন বিপদে ওর মা নাকি একটুও ভেঙে পড়েননি। রুথকে শক্ত হাতে আগলে রেখে বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছেন। ওর বুদ্ধিমতী মা ছোট ভাইবোনদের বাবার কাছে রেখে রুথকে অনেক দূরে তার বোনের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
রুথের খালা একটা এনজিওতে ভালো চাকরি করতেন। অবিবাহিতা, একা থাকতেন। সেখানে আলো বাতাসহীন একটা ঘরে রুথ অনেকটা বন্দীর মতোই ছিল। ভাগ্যক্রমে ওই বাসায় ছিল বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা। একাকী সময়গুলো রুথ বই পড়ে কাটিয়েছিল। তার মধ্যে স্নো হোয়াইট ছিল ওর সব থেকে প্রিয়। অসংখ্যবার সে রূপকথার সেই বইটি পড়েছিল।
রুথের মা রুথের সঙ্গেই বোনের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ওর বাবা ছোট ভাইবোনদের আনা-নেওয়া করতেন। এভাবেই দিন কেটে যায়। বদ্ধ সেই ঘরেই একদিন রুথ ওর মেয়ের জন্ম দেয়। ফুটফুটে তুলতুলে কৃষ্ণ কালো মেয়ে। ও ওর মেয়ের নাম রাখে ‘স্নো হোয়াইট’।
রুথের মা রুথকে আর বাসায় নিয়ে যাননি। খালার বাসায় রেখে রুথের সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাসায় ফিরে যান। ওর বাবা ছাড়া গ্রামের সবাই জেনে যায় যে, রুথের মায়ের আরও একটি মেয়ে হয়েছে। ভাইবোনেরা জানল যে ওদের ছোট একটা বোন হয়েছে। আর প্রতিবেশীরা জানল যে রুথ শহরে থেকেই পড়াশুনা করবে। মাঝে মাঝে বাসায় আসবে।
রুথ খালার বাসায় থেকে আবার স্কুলে ভর্তি হয়। একদা হাসিখুশি রুথ আরও চুপচাপ। ও দিন-রাত শুধু বই নিয়েই থাকত। একদা অমনোযোগী রুথ ক্লাসের মধ্যে সব থেকে ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। রুথ স্নো হোয়াইটকে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠত। পরীক্ষা শেষে করেই সে ছুটে গেল গ্রামের বাসায়। ছোট্ট স্নো তখন ভাঙা ভাঙা স্বরে রুথের মাকে মা ডাকতে শিখেছে। রুথ তার কাছে অচেনা।
রুথ খালার বাসায় ফিরে আসে। পড়াশুনার ফাঁকেই মাঝে মাঝে স্নোকে বাসায় গিয়ে দেখে আসত। এভাবেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। রুথ কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশুনার ধাপ শেষ করে। ভালো রেজাল্টের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে রুথ নিয়োগ পায়। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে আজ সে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে এসেছে।
রুথের কাছে জানতে পারি যে, স্নো এখন অনেক বড় হয়েছে। রুথকে তার বড় বোন বলেই সে জানে। ম্লান হেসে রুথ জানায়, স্নো কোনোদিন জানবে না কে তার আসল মা।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনের মতো রুথ রুমে ফিরে গেল। আর আমি ঝিম মেরে ভাবতে লাগলাম। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও রুথ নিজেকে গড়ে তুলেছে, পরিবারের সাপোর্ট পেয়েছে, ওর মেয়েটাকে ও নিজের মেয়ে হিসেবে না পেলেও, মেয়েটা তো ওর পরিবার পেয়েছে!
রুথ এবং ওর মা প্রমাণ করছে যে ধর্ষণের শিকার হলেই মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায় না। নিষ্পাপ রুথ তার জীবনকে অন্ধকারে মিশে যেতে দেয়নি। ও হেরে যায়নি। ও ওর দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেছে। ভাইবোনেরা ভালো স্কুল-কলেজে পড়ছে। ওর স্নো হোয়াইট বড় হয়ে উঠছে।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রুথ দাঁড়িয়ে আছে খোলা মাঠে। হয়তো সে তার আদরের মেয়ে স্নো হোয়াইটকে অনুভব করছে সারা গায়ে শুভ্র স্নোতে আবৃত করে।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি লেখার আগে আমি রুথের কাছে অনুমতি চেয়ে নিয়েছি)
লিখেছেনঃ জিনিয়া জাহিদ, এডিলেড (অস্ট্রেলিয়া) থেকে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত।

No comments:

Post a Comment

Powered by Blogger.